অংশগ্রহণে — অমল সান্যাল (Amal.Sanyal@lincoln.ac.nz), নিলার্য তালুকদার (nilarya@gmail.com), অর্ঘ বাগচী (bagchi.argha@gmail.com), দীপংকর দাশগুপ্ত (d.dasgupta@gmail.com)। অন্য সকলেই আমন্ত্রিত।

(দীপংকর দাশগুপ্ত)
নেড়ি দেখ নেড়া রোজ তোর পিছে ছোটে,
কাতর চক্ষে, মুখে বুলি নাহি ফোটে।
বৃথাই ঝোলাতে ভরে রোদে রোদে ঘোরা,
টুকটুকে দু ডজন গোলাপের তোড়া।
গোলাপ শুকিয়ে কাঠ, আছে শুধু কাঁটা,
দিবারাত খায় খোঁচা সাথে তোর ঝাঁটা।
নেড়ি ওরে এত করে তোর পানে নেড়া,
চেয়ে চেয়ে সত্যিই হবে কভু ভেড়া।
বিপদে তখন নেড়ি পড়বি ভীষণ,
ভেড়া হয়ে নেড়া পেলে পাতে প্রোমোশন।
(নিলার্য তালুকদার)
নেড়ি বলে হোক ভেড়া তাতে কী বা আসে যায়!
পিছনেতে কুড়ি জন, এইভাবে থাকা দায়।
প্যালা আছে, কেলো আছে, ও পাড়ার দাদা ভাই,
কলেজে-তে বিলু বলে নলবনে চল যাই।
কোথাকার কোন নেড়া, নাছোড় এক বান্দা,
কবে থেকে বলি তারে, ভালো না এ ধান্দা।
আছে কিছু তার কাছে? মোবাইল বা রেস্ত?
কাঁধে এক ঝোলা ব্যাগ, বলে এই বেশ তো!
এই নিয়ে যাই পাও, নেড়িকে তো পাবে না,
তোর সাথে নেড়ি হায় ফুচকাও খাবে না।

(দীপংকর দাশগুপ্ত)
নেড়ির কথা শুনে,
বদন ঢেকে চুনে,
ছুটলো নেড়া নেড়ির পাড়ায়,
দেখতে নিজেই গুণে।
সুয্যি তখন সবে,
দিচ্ছে দেখা ভবে,
বিশটা বলদ দেখলো নেড়া,
হাম্বা হাম্বা রবে —
চড়ছে নেড়ির দোরে,
কাক ডাকা সেই ভোরে,
খাওয়াচ্ছে ঘাস তাদের নেড়ি,
বস্তা ভরে ভরে।
কাউরে বিলু, কাউরে কেলে,
ডাকছে নেড়ি, পড়ছে হেলে,
হাঁ করে তাই দেখলো নেড়া
সকল কম্মো ফেলে।
একটি বারই নেড়ি,
নেড়ার পানে হেরি,
বললো আধো মিষ্টি গলায়,
বুদ্ধু তুমি very!
হৃদয় আমার জিতে,
পারবে তবেই নিতে,
ঘাস চিবোলে রোজ সকালে
নয় রে কাব্যে গীতে।
(নিলার্য তালুকদার)
নেড়িদের উঠোন ঘিরে, গোটা কুড়ি বলদ চরে,
দেখে নেড়া ভীষণ জোরে, বিষম খেলো ঊনিশবার।
এবারে কী উপায় তবে, শেষে ঘাস গিলতে হবে?
সে কথাই খানিক ভেবে, এলো জল চক্ষে তার।
নেড়াটা যে কেবল ভোগে, রোজ রোজ পেটের রোগে
সেই কথা সবার আগে, চিন্তা করে হলোই সার।
পর পর তিন রজনী, নেড়া দুই চোখ বোজেনি,
তবু হায় বুঝলো না সে, নেড়ির এ ছাই কি আব্দার।
শেষে মাথা চুলকে ঘেঁটে, কোশ দুই রাস্তা হেঁটে
নেড়িদের বাড়ির গেটে, নাড়লো কড়া দরজাটার।
বলে নেড়া, শোন রে চামি, তোর কথা মানবো আমি
যদি খাস আমায় হামি, ঘাস প্রতি তুই আড়াই বার।
(দীপংকর দাশগুপ্ত)
নেড়ি বলে নেড়া রে,
মগজেতে ক্যারা রে
কতো তোর ভাবি শুধু আমি।
এগিয়ে দে গলা রে,
ধরে তোরে কলারে
গোয়ালে খাওয়াবো কতো হামি।
বিরহ কাতর রে,
পথ চেয়ে তোর রে
ডাকে সেথা কমলিনী গাভী।
তোর দেখা পেলে রে,
প্রতীক্ষা ফেলে রে
খাবে হামি যত তুই চাবি।
গাবে তোর বাসরে,
জমিয়ে রে আসরে
ঢাকুরিয়া থেকে এসে মশা।
নেড়া, নেড়া, নেড়া রে
ওখানেই বেড়া রে,
হেথা না বাড়িয়ে দুর্দশা।
(দীপংকর দাশগুপ্ত)
ভেবে ভেবে শেষে
বলে নেড়া এসে
শোন নেড়ি, চলি তবে
ভিন কোনো দেশে।
ও পাড়ার নেলি
পাঁউরুটি জেলি
খাওয়াচ্ছে অমলেটও
ধরে বেঁধে ডেলি।
কি বা ঠিক তাতে
ধরে মোর হাতে,
যাবে না কো চলে নেলি
কেটে মাঝরাতে?
নাও যদি যায়,
কি বা আসে তায়,
কে বা নেড়ি, কে বা নেলি?
বুঝি কি রে হায়!
নেড়ি নেড়ি ওরে!
কালই ট্রেনে করে,
যাবো চলে, রবি তুই
বলদেই চড়ে।

ছবি – অমল সান্যাল
(নিলার্য তালুকদার — দীপংকর দাশগুপ্ত)
কান দুটি করে খাড়া নেড়ি শুনে ভয়ে সারা
শেষমেষ নেলি কিনা নেড়ারে পটায়?
জ্বলে আঁখি আগুনে ভরা আজ এ ফাগুনে
কে জানে কি অঘটন পাঁচিটা ঘটায়!
কে জানতো ফেলে ছিপ কপালে সোনালি টিপ
বসেছিলো পরে নেলি লালপেড়ে শাড়ি?
আহা কি রূপের ছিরি! দাঁত করে কিড়িমিড়ি
ভাবে নেড়ি, হায় নেড়া এই তোর নারী?
করে যা রে তোড়জোড় নেলি টিপখানা তোর,
ধেবড়িয়ে, চুল ধরে এনে হেথা টেনে
হিম্মৎ কয় কারে বোঝাবো রে একেবারে
দেখে নেবো কার সাথে কে বা যায় ট্রেনে!
নেড়াটারও বলিহারি এত সাত-তাড়াতাড়ি
কবে কে রে proposal-এ দেয় দিয়ে সায়?
তাই বলে তুই জেলি পাঁউরুটি দিয়ে খেলি?
এতটুকু ঘিলু তোর নেই কি মাথায়?
ষাঁড়েরা যে বাহানা এটা কি বুঝিস না
গপ্গপ্ করে কিনা অমলেট খাস!
ঘাস নয়, আলু দম মালপোয়া, চমচম
রাখবো আমিও এনে বল কতো চাস?
এই বলে ভুলিয়ে এনে হেথা ঝুলিয়ে
নেড়াকে রাখতে হবে আরও কিছুকাল
মালপোয়া পেট ভরে খাবে সে, রইবে ঘোরে
আমিও চিবাব সুখে তার পরকাল!
কিন্তু হবে না কাম কমালে নিজেরই দাম
তাই খাসা দেব গ্যাস — মোর বড়দার
পড়লে চোখেতে ওরে নিয়ে গিয়ে বেঁধে ধরে
আসবে থানাতে তোরে রেখে খড়দার।
(দীপংকর দাশগুপ্ত)
মুখ হাঁড়ি করে নেড়ি ভেবে সে আকুল!
ফের কেমনেতে নেড়া
আস্ত একটা ভেড়া
বনবে, এ কাজে শেষে দিতে হবে গুল?
এদিকে যে নেলি ছুঁড়ি রাখছে নজর!
সাবধানে গ্যাস দিতে
হবে, নয় যাবে জিতে
নেলিই, করি না যত গজর গজর।
বড়দা, ছোড়দা মোর আসলে তো কেউ নেই!
টিকবে না ধোপেতে
নেলি এক কোপেতে
বলি দিয়ে সবারে সে নাচবে রে ধেই ধেই।
নেড়াও ঘরেতে বসে করে দুশ্চিন্তা।
নেলি যে পুরোটা উড়ো
খবর, সে ভেলিগুড়ও
পায়নি, কোথায় জেলি কেঁদে কাটে দিন তা—
নেড়ি যদি ধরে ফেলে তার এই ধাপ্পা?
শক্তপোক্ত ষাঁড়
বিশটা পিছনে তার
লেলিয়ে সে নির্ঘাৎ দেবে হয়ে খাপ্পা—
কোথায় পালাবে নেড়া পড়ে সে অবস্থায়?
দিলে ষাঁড়ে গুঁতিয়ে
ডাক্তারে খুঁটিয়ে
দেখে তারে বেচে দেবে মর্গেতে সস্তায়!

(অর্ঘ বাগচী)
ভেবে ভেবে কেটে গেলো সাড়ে-তিনমাস
বাতাসে গুজব রটে ফিশ্-ফুশ্-ফাশ্
নেড়ি শোনে কান পেতে মনে অবিশাস
নেড়া নাকি হয়ে গেছে খাঁটি দেবদাস।
হায় তারে কোন বলে ইলোপিলো নেলি,
ফষ্টিনষ্টি কতো শোনে ডেলি ডেলি;
একমুখ দাড়িগোঁফ, কত কী যে আরো –
শুনে নেড়ি বলে তেড়ি, আমি তবে ‘পারো’।
কোথা সে ‘চন্দ্রমুখী’ কানকাটা নেলি?
কোথায় সে রাজা ভোজ, কোথা গাঙু তেলি!
নাহয় খাইয়েছিলি পাঁউরুটি-জেলি
এমনই সহজে ভোঁদা গলে তুই গেলি?
আজই আমি থানা দেবো নেড়ার বাড়িতে,
দেখি কে ঠেকায় ভাব নেড়া ও নেড়িতে।
(দীপংকর দাশগুপ্ত)
আর দেরি না আর না আজ
থাকলো পড়ে সকল কাজ
ভোর সকালে ছুটলো নেড়ি
উজিয়ে নেড়ার বাড়ি –
কিন্তু বিধি হায় রে বাম
একটিও নেই বাস বা ট্রাম
ঘন্টা দশেক রাজ্য জুড়ে
বন্ ধ হয়েছে জারি।
ভাবলো নেড়ি তুই গেলি
এমন দিনে ঠিক নেলি
দেবেই দেবে পঁচিশটা গোল
সবুজ ফাঁকা মাঠে।
বাস গাড়ি তাই যাক চুলোয়
দোষ কী আমার পা গুলোয়?
পুড়িয়ে আসি ধড়টি নেলির
কেওড়াতলার ঘাটে।
বাজছে তখন দেড়টা ঠিক
জ্ঞান হারিয়ে দিগ্ বিদিক
পৌঁছলো সে নেড়ার বাড়ি
এক মাথা রোদ্দুরে।
বিশাল সেথা ঝুলছে তালা
বাড়লো শুধুই বুকের জ্বালা
বৃথাই হেঁটে বেহালা থেকে
আসলো কেষ্টপুরে!
যা যা রে তুই যা নেড়া
নেলির সাথেই যা বেড়া
এই বলে সে মাতিয়ে পাড়া
জুড়লো বিরাট কান্না।
বন্ ধ ভুললো পার্টিরা
আসলো ছুটে মা ঝি-রা
ভীড় করে সব, উঠলো মাথায়
সেদিন রান্না বান্না।

ছবি — অমল সান্যাল
(অর্ঘ বাগচী)
নেড়া, সে কি করছিলো? লাল রঙে লিখছিলো
দিস্তে দিস্তে পাতা জুড়ে প্রেমপত্র
কিম্ভুত ভাষা তার ভাবনাও নিরাকার
তবু তাতে ভরা ভালোবাসা সর্বত্র।
‘শ্রীমতিচরণে নেড়ি আর করিও না দেরী
প্রাণনাথ তব হায় পটল তুলিছে প্রায়
আদরিনী নেড়ি তোরে অনুরোধ করজোড়ে
একবার মার উঁকি হৃদয়ের জানালায়।’
এরকমই কতশত লিখেছিলো মনোমতো
হিম্মৎ ছিলো না তো নেড়িকে তা পাঠানোর
বিরহকাতর হয়ে ডিসিশন নিলো নিয়ে
সাধু হয়ে অবশেষ জীবনটা কাটানোর।
চুলটুল ছিলো না জটা তাই হলো না
নাহয় শ্রমণ হবে, তথাগতশরনে
দুই চোখে জলধারা নেড়া হয়ে গৃহহারা
ঝোলাব্যাগ কাঁধে চলে জুতাহীন চরণে।
যাবে সিধা কাশীধাম নেবে সেথা সাধুনাম
খাবে নয় ভিক্ষার পান্তা ও টকডাল।
হেঁটে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছিয়ে সে শোনে
গাড়ি নেই, আজ দশ ঘন্টার হরতাল।
হায় নেড়া মহারাজ মাথায় পড়লো বাজ!
প্রেম নেই, ইল্ লাক্, নেই বৈরাগ্যও
আবার কেষ্টপুরে উজিয়ে ভরদুপুরে?
পায়ে হেঁটে? হায় ছিল এই দুর্ভাগ্যও?

ছবি — অমল সান্যাল
নেড়ার কীর্তন (দীপংকর দাশগুপ্ত)
সখী রে এ এ এ এ এ …
বিহনেতে তব
কত কাল রব?
ত্যজিব আজিকে প্রাণে …
কাটা পড়ে ট্রেনে
যাইব হেভেনে
আজি এ ইস্টিশানে!
কিন্তু …
কীরূপে যাইব?
কহ সখী, কহ মোরে
কীরূপে যাইব?
বন্ধ্-এর এই দিনে
একটিও যে ট্রেন নাই।
হেভেনের ছাড় বাত
যেতে হব কুপোকাত
এমন কী বর্ধমানে ….
সখী রে এ এ এ এ এ …
কোথা যাই, ক্যাম্ নে যাই?
তোরে বিনা সুখ নাই।
হায় অভাগার এই জীবনে!
চলি রে মরিতে।
চলি রে, চলি রে, চলি রে মরিতে।
হাওড়া ব্রিজে চইড়ব আমি
যমের ঠ্যাঙে ধরিতে …
কুলুকুলু বহে নদী
সাহসে কুলায় যদি
লাফায়ে পড়িব সেই স্থানে …
সখী রে এ এ এ এ এ …
কণ্ঠ রত্না দাস — তবলা অরুণ দত্ত
(অমল সান্যাল)
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে কৃষ্ণপক্ষ একাদশে নেড়া নেড়ি কাহিনি যে পড়ে|
প্রণয়ে বিজয়ী হয় পিতামাতা বিয়া দেয় সুখে থাকে দেবতার বরে||
তিথি কৃষ্ণা একাদশী কলিকাতা বানভাসি নেড়া ভাসে নয়নের জলে|
কভু কাঁদে কভু হাসে কভু বুক বাঁধে আশে কভু ভাবে ফাঁস দেই গলে||
হে বিধি পাষাণ হেন আমারে গড়িলে কেন নেড়ি না হৈল যদি মোর|
লও হে পরাণ মম দুঃখ কর উপশম শ্রেয় গণি মরণের ক্রোড়||
অবিরাম বরিষণে কলিকাতা ভাসে বানে শেষ দেখা সেই শনিবার|
কি দিবা কি শর্বরী তিমির রেখেছে ঘেরি দুখবারি ঝরে অনিবার||
বরষা পিছিল পথে হয়ত বা কোথা হতে ধেনু লয়ে নেড়ি ফেরে গেহে|
আসিক্ত নিচোল আহা, ঠিক ভাবিয়াছি যাহা- আঁচলেতে তাই লেগে, এহে||
অবুঝ হৃদয় চাহে সযত্নে মুছায়ে তাহে শুকায়ে রাখিব করি ঘুঁটে|
করিব ভূষণ অঙ্গে কভু যেন নাহি ভাঙ্গে অস্থি মম যদিও বা টুটে||
বক্ষ বাঁধি হেন আশে বেহালা যদ্যপি ভাসে নেড়া চলে মীন যথা জলে|
ঊর্ধে দেবলোক হতে ধন্য ধন্য রব ওঠে অপ্সরীরা দেখে কুতুহলে||
স্বয়ং কৈলাসপতি বুঝেনা নেড়ার মতি স্নেহভরে নন্দীরে শুধায়|
কে ঐ তরুণ নর, বর্ষণে ত্যজিছে ঘর, আহা সে কি কাতর ক্ষুধায়?
সবিনয়ে নন্দী কহে প্রভু উহা নর নহে, নেড়া নামে মর্তে পরিচিতি|
পতঙ্গ আলোকে ধায়, ও চলেছে বেহালায়, আকর্ষিছে নেড়ির পীরিতি||
(অমল সান্যাল]
বারিসিক্ত ব্যাগ হতে এ সুদীর্ঘ জলপথে গোলাপেরা গিয়াছে ভাসিয়া|
প্রবল বর্ষণ শিরে নেড়া চলে ধীরে ধীরে নেড়ি-গৃহ পরিল আসিয়া||
ঐ ছাতটির নীচে হয়তো বসিয়া আছে ক্রোড়ে উষ্ণ খিচুড়ির থালা|
আঙ্গিনার ঐ কোনে কতবার সযতনে খুলিয়াছে জাবনার ছালা||
ঐ প্রাচীরের পিছে হয়তো সে গাঁথিয়াছে কত বনযূথিকার মালা-
এই চিন্তা ছেদ করি অন্ধকার ভেদ করি উঠিল কর্কশ নাদ ‘শালা’||
ঝটিতি দেখয়ে নেড়া অদূরে দণ্ডিত খাড়া মহাপরাক্রম নেড়িভ্রাতা|
মনে ছিল সাধ এই, শালা ডাকে ইহাকেই, বিপরীত করিল বিধাতা||
গাছ থেকে কাঁচা পেঁপে চুরি গেছে কয় ক্ষেপে আর গেছে যত বাটি ঘটি|
একখানি বারকোশ পিসীমার বালাপোষ আর পিতাঠাকুরের চটি||
নাহি কোন সংশয় চোরেরা নেড়াই হয় ধরিতে কঠিন হয় যাতে|
আর দেখে মনে হবে উলটিয়া নাহি খাবে ভাজা মত্স যদি পরে পাতে||
আমার হিসাব মত বহুদিন চৌর্যে রত, নহে ব্যক্তি সামান্য তস্কর|
হুংকারিল নেড়িভ্রাতা শোনে সারা কলিকাতা যেন ডাকে সিপাহীলস্কর||
সহসা নেড়ার কানে কে কহিল কে বা জানে মরে গেলে পাইবেনা নেড়ি|
শ্বাসবায়ু করি স্থির নীর গর্ভে রাখো শির পলমাত্র না করিয়া দেরী||
ঝোলা ব্যাগ বিবর্জিয়া চলো ডুব-সন্তরিয়া চায়ের বিপণি ননীদার|
তথায় পৌঁছিয়া তবে পুনরায় শ্বাস লবে তারপরে কে ধরিবে আর||
(অমল সান্যাল)
নেড়ারে ফিরিতে দেখি চিতাভস্ম অঙ্গে মাখি মহাদেব ফিরিলেন ধ্যানে|
মদন আহ্লাদে ভাসে রতি তার বাহুপাশে এই যাত্রা বাঁচিলাম প্রাণে||
সুরলোকে ফিরে প্রাণ গন্ধর্বেরা ধরে গান কিন্নরীরা নৃত্য করে ছলে|
দেবতারা সুরা চাখে অপাঙ্গে নজর রাখে উর্বশীর স্খলিত অঞ্চলে||
আনন্দে আহ্লাদে গলি দেবতা সকলে মিলি সেই রাত্রে করিল নির্ণয়|
এ কাহিনি যে পড়িবে মর্তলোকে প্রচারিবে সে রহিবে প্রণয়ে নির্ভয়||
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে কৃষ্ণপক্ষ একাদশে নেড়া নেড়ি কাহিনি যে পড়ে|
প্রণয়ে বিজয়ী হয় পিতামাতা বিয়া দেয় সুখে থাকে দেবতার বরে||
(দীপংকর দাশগুপ্ত)
কিন্তু দাদা! ও দাদা, কিন্তু দাদা!
নেড়ির কথা, ও দাদা, নেড়ির ব্যথা
একটি বারও পড়ছে না কী তোমার মনে?
কেষ্টপুরে, ও দাদা, কেষ্টপুরে
বেহাগ সুরে, বল কেন, ভর দুপুরে
ফাটিয়ে গলা, কাঁদছে সে আজ মরণ পণে?
শোন রে ভেড়া, ওরে তুই, বল রে নেড়া
বেশ তো ছিলি, কেন তুই, আমায় দিলি
এমন দাগা, বাঁধলি বাসা কোন চুলোতে গিয়ে?
খাইয়ে জেলি, তোকে রোজ, খাইয়ে নেলি
বন বাদাড়ে, চড়ে বসে, তোরই ঘাড়ে
সাতটি পাকে মরছে ঘুরে, নিজেই উলু দিয়ে!
বেটাচ্ছেলে, দেখ তোরে, আস্ত পেলে
খাইয়ে জোলাপ, দেওয়াব, বত্রিশ লাফ
দেখব নেলি কেমন করে অঙ্গে রাখে চেলি!
বকে বিড়বিড়, যায় নেড়ি, মন চিড়বিড়
কেষ্টপুরে, নেই নেড়া, তাই সে ঘুরে
বেহালা ফেরে, ভাবে হাফসোল নিজেই খেলি!
ফিরল সাঁঝে, ঠিক যেই, আটটা বাজে
টিপটিপিয়ে, ঝরে জল, ঝিপঝিপিয়ে
ননীদার চায়ের স্টলের সামনে সে হাঁপায় —
কিন্তু এ কী, দেখে সে, ঠিক না মেকি?
ভরা এক প্লেট, খায় নেড়া, ভাজা অমলেট
বারি সিঞ্চিত, ক্রোধে কম্পিত, দুনিয়া কাঁপায়ে —
শোন রে হারু! কয় নেড়ি, নে’ আয় ঝাড়ু
নেই কী মরদ, এ পাড়ার, নেড়ায় তাড়ায়?
শুনে সেই রব, পড়্ শিরা আসে, মাথায় ছাতা —
হাতে পাটকেল, ভয়ে কয়, কোথা রাস্কেল?
হারু ভৃত্য, সেও করে, ঝাড়ু নৃত্য
যারে দেখে নেড়া ভেবেছিল ভ্রমে নেড়ির ভ্রাতা!
(অর্ঘ বাগচী)
কুমোরপাড়ায় হারুর বাড়ি, বোঝাই মাথায় বুদ্ধি ভারি,
দেহের বরণ কৃষ্ণশরণ, শক্ত যেন বেতের গড়ন।
মানুষ তো নয়, হারুকুমার, যেমন গাধা, তেমন গোঁয়ার।
কবে সেই ছোট্টবেলায়, বাড়িতে ডাকাত পড়ায়
খেয়েছিল মাথায় লাঠি, সেই থেকে মাথায় মাটি
চোর খুঁজে পাড়ায় পাড়ায়, ঝাড়ু হাতে দৌড়ে বেড়ায়।
ন্যাপাদের চা-র দোকানে ঝাড়ু নিয়ে ওই ওখানে
হারু যেই করলে তাড়া, নেড়া বলে একটু দাঁড়া
দোকানের এই ধারে না বেড়ার এক ফাঁক আছে না
সেখানেই হোঁচট খেয়ে নেড়া ফের পালায় ধেয়ে
ব্যাটা হারু ধাড়ি গণ্ডার, বিনা মেঘে যেন থান্ডার
দিলে খুব ঝাড়ুর বাড়ি একদম এলোপাথাড়ি
নেড়া যেন খাস্তা পাঁপড়। হাওড়ার সস্তা কাপড়-
দুই হাতে চাগিয়ে তুলে দৌড়িয়ে সামাল দিলে
হারু তবু দাপিয়ে বেড়ায়, নেড়ি তাকে ঠাণ্ডা করায়;
নেড়া দেয় সিধা পিঠটান, চাচা বাঁচা আপন পেরান।
দু-মাইল দৌড়ে এসে, নেড়া শেষে ভাবতে বসে
বলেছিল গুপীর কাকা, একবার হাতটা দেখা
এইবারে সঙ্গোপনে, যাই মধু গুপ্ত লেনে।
বেহালার বেহাল মোড়ে, নেড়ি ভাবে – কিসের ঘোরে
নেড়াটাকে দিলাম তাড়া, আর সে কি পড়বে ধরা?
বোঝা ভার নেড়ার ভড়ং, পিউদিকে শুধাই বরং।
(অমল সান্যাল)
(১)
নেড়ির মাসতুত দিদি পিউ
দমদমে প্লেন তাঁর সাতটায় ডিউ|
বিলেতেই লেখাপড়া, ঠিকানাও ইউকে-
শ্রদ্ধা করে পরিবারে সকলেই পিউকে|
প্রত্যাখ্যান করিয়াছে অবহেলে পিউ
অগণিত গুণমুগ্ধ ফিরিঙ্গির কিউ।
সেই পিউ দিদি,
যিনি পরম নির্ভর আর আশ্বাসের স্থল,
স্নেহভরে কহিলেন “আয়, শুনি, বল|”
শুনিলেন একমনে, গ্রীবা রাখি একই দিকে কাত-
যদিওবা বুলালেন হাত-
মাঝে মাঝে
কপালের ভাঁজে|
অবশেষে-
জ্ঞানের গভীর থেকে পিউদির কণ্ঠ আসে ভেসে-
“অন্য কারো solution এ ব্যাপারে হবে একপেশে|
লাইফের এই সব issue
নিজে নিজে face করো দৃঢ়তার সাথে-
এখন তো নও কিছু শিশু|
তোমার হাতেই আছে চাবি|
মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়িয়ে সম্মুখে
উচ্চ শির ঋজু ভঙ্গী চোখে চোখ রেখে
সসম্মানে পেশ করো আপনার দাবী|”

ছবি — অমল সান্যাল
(২)
“পশুপাখি নেড়া নেড়ী বস্তুভেদ মায়া
একই সত্তা সৃষ্টি করে অজস্রের ছায়া।
হরিদাস পাল থেকে উত্তমকুমার
সবারই আকাঙ্ক্ষা সেই ভূমার চুমার।
যাকে খুশী ভালোবাসো পশুপাখি নেড়ী
মনে শুধু রেখো তারা রূপভেদ এঁরই।…”
নেড়ার নির্বেদ চিত্ত পেল নব দিশা|
অরুণ উদয় হল ভেদ করি আজন্মের নিশা|
(৩)
ঠাকুরপুকুরে নেড়ী দেখা পেল তার-অর্থাৎ নেড়ার|
ঐ সে বসিয়া আছে জয়হিন্দ্ সেলুনের ধাপে|
আজ যেন নেড়ী তোর গলা নাহি কাঁপে|
নিজের হাতেই চাবি, ক্লিক্ ক্ল্যাক্ খুলে ফেল্ তালা
দিনক্ষণ দেখে পরে পরালেই হবে বরমালা|
ভাল করে গোঁজা ছিল স্মৃতির ফোকরে
সারাদিন জপিয়াছে ডায়ালগ যাহা|
নেড়ি অতি যত্নভরে নামাইল তাহা।
ডায়ালগ সারি
নেড়ার উত্তর লাগি রুদ্ধশ্বাস নেড়ী-
ক্লিক্ ক্ল্যাক্- আর কত দেরী?
নেড়ার কণ্ঠের থেকে আসিল এবারে
ধীরে অতি ধীরে,
যেন মহাবিশ্বের বাতায়ন খুলি-
“শোনো নেড়ি,
আমাদের চতুর্দিক ঘেরি
মায়ার কুহকরাশি ঠাসা-
আড়াল করিয়া আছে সত্য আর আনন্দের ভাষা|
কুকুর, মেকুর, তুমি, আসলে অভেদ,
বেহালাতে ফিরে যাও, please নয় জেদ।

(৪)
লোডশেডিং এর সন্ধ্যা ঘন হয়ে নামে
গৃহকোনে ফুটপাথে mall-এ বাসে ট্রামে|
নেড়ীকে সস্নেহে ধরে নিয়ে গিয়ে ছাতে,
তেতালাতে,
পিউদিদি স্নেহভরে শুধালেন, “কিরে?”
উত্তর ভাসিয়া এল অন্ধকার চিরে|
“আজকাল ঠেক্ তার ঠাকুরপুকুর-
বলে নাকি আমি কোন্ মেকুর কুকুর!
গাঁজারুর দৃষ্টি চোখে, হয়ত চরস ঠোকে-
তা যদি না হয় তবে অন্য কোনো ড্রাগ”
স্কন্ধ ঝাঁকালো নেড়ি-যাকে বলে shrug |
“শতগুণ ভালো ছেলে হরিপদ নাগ|”
অন্ধকার গাঢ় হয়ে নামে বেহালাতে
নতদৃষ্টি দুই বোন বসে থাকে ছাতে|
(দীপংকর দাশগুপ্ত)
ঢং ঢং ঢং রাত বারোটায় গির্জেটাতেও ঘণ্টা
বাজল রে হায়,
তবুও না পায়
কুল কিনারা, হাজার ভেবেও আজকে নেড়ির মনটা!
পিউ দিদি রে! বিলেত ফিরে এই শেখালি শেষে?
জানিয়ে দাবি
খেলাম খাবি
ঘটিয়ে এলাম কেমনতর কাণ্ড সব্বোনেশে!
নেড়া নেই ভেড়া, বরঞ্চ দেখ সারমেয় হনু আমি
মার্জারও বটে –
লিখে এই ঘটে
দাঁত বের করে আকাশেতে হাসে বেটা অন্তর্যামী।
***
এরপর যামিনী নীরব ক্ষণকাল —
শুধুমাত্র নেড়ির প্যাচাল
ভিন্ন আর সব
সম্পূর্ণ নীরব
নিশ্ছিদ্র আঁধারে নেই সামান্য আলোর ভেজাল!
***
অকস্মাৎ গৃহস্থের নিদ্রা টুটায়ে এ কী হুঙ্কার?
আতঙ্কিত দারোগা পুলিশ ভয়ে ভেগে পার —
বিস্ফারিত নেত্রে অবলোকে নেড়ি
প্রলয় নাচনে মত্ত তারে ঘেরি ঘেরি
ফিরিঙ্গি নাশিনী দশভুজা পিউ দিদি তার।
ফুৎকারিয়া নেড়িরে কয় দিদি পিউ – হাতে ডাণ্ডা
এত বড় সাহস তার নিজেই করব – আজ ঠাণ্ডা
ঠিকানাটা লিখে দিয়ে বসে থাক গিয়ে
আমিই করব তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে
মেকুর কুকুর কে বা — ধরা পড়বেই তার – আজ ফান্ডা।
***
শুনে নেড়ি হতবাক
নেলি বুঝি হল পিউ
নেড়া তুই এত কিঁউ
বাধা দিস খেতে সাত পাক?
কিন্তু এ কী – বাপরে বাপ!
নিশ্চয়ই এ নেলির শাপ
বুঝল নেড়ি পিউ বজ্জাত ভারি।
বাঁচবার আজ কী উপায়?
হরিপদ নাগ আয় রে আয় —
ঠিকানা দেয় যত্নে নেড়ি তারই।
(অর্ঘ বাগচী)
ঠাকুরপুকুরে,
জয়হিন্দ সেলুনের উপকণ্ঠে
কেলাবের মোড়ে,
ভোরের আকাশ,
তুলি দিয়ে এঁকে দেয় তুলোভরা
মেঘের আভাস।
মেঘরূপী টেডি,
ব্রাহ্মমুহূর্তে আজ
সেজেগুজে হয়ে গেছে রেডি,
রেডিওস্টেশনে,
রেকর্ডেড বীরেন্দ্র ভদ্র সিডি বন্দী
চন্ডীস্তবনে।
নিদ্রাহীন নেড়া,
দেয়ালেতে আধাঠেসা, চোখ বোজা,
কানদুটি খাড়া,
মন্ত্র ভেসে আসে,
মহালয়া মহাবেগে মহাবেশে
নেড়ার মানসে।
যা নেড়া মাতৃভোগেষু, বুদ্ধুরূপেণ সংস্থিতঃ।
বুদ্ধিস্তস্যৈ বুদ্ধিস্তস্যৈ অকালপক্ক অকালমৃতঃ।।
গোয়্যান্ড বাইসাম্ পেপার্টিসু, চক্ষুজলে সংস্থিতঃ।
সুযোগ তস্যৈ সুযোগ তস্যৈ আত্মহস্তে আত্মহতঃ।।
থিঙ্কোভার্দিস্ সিলি ইসু, বাইট্ফিঙ্গার্নেল গ্রোথঃ।
অ্যাপোলজ্যৈ অ্যাপোলজ্যৈ নেড়িহস্ত করংধৃতঃ।।
চোখ খোলে নেড়া
চমকিয়ে চেয়ে দেখে কোথায় সে,
এ কাদের পাড়া?
মৃদু হেসে ভাবে
পৃথিবীতে কে বা কার জেনে আর কি বা এসে যাবে।
ফের বোজে চোখ
আবার কানেতে আসে মহামন্ত্র মহামায়াশ্লোক।
ইতিহাসে নেড়িজাতি হিপোক্রিয়সি সর্বদাঃ।
সোক্রাতিশ্চ মতিচ্ছন্নঃ নেড়াঃ সদা বলির্গাধাঃ।।
(ক্রমশ)
কণ্ঠ রত্না দাস — তবলা অরুণ দত্ত